স্বদেশ ডেস্ক:
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় অসন্তুষ্ট বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার প্রতি সরকারের খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্য থেকে সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আসছে। এ কারণে মনে হচ্ছে সরকারের ভেতরে ও বাইরে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এ নিয়ে জনমনে এক ধরনের সংশয়ও তৈরি হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় দলের পক্ষ থেকে জনগণের ভোটাধিকার আদায়ে ৫ আগস্টের মতো রাজপথে নামার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজন হলে ভোটাধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির নেতারা। তারা আরও বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে বসে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছেন। দেশে ও দেশের বাইরের নানা চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এক অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে সরকার ব্যর্থ হতে পারে। এ কারণে বিএনপি দ্রুত একটি নির্বাচনের দাবি তুলছে যাতে জনগণের সরকার ক্ষমতায় এসে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পারবে। এদিকে গত সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার নির্বাচনী এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে এক জনসভায় ভোটাধিকার আদায়ে ৫ আগস্টের মতো রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। দেশের জন্য প্রয়োজনে আরেকটা লড়াই হবে। ভোটের অধিকার আদায়ে ৫ আগস্টের মতো আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান ৩১ দফা দিয়েছিলেন সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে। কৃষকদের বিরুদ্ধে কোনো কারসাজি আমরা চাই না। শ্রমিকরা যেন তাদের ন্যায্য মজুরি পান সেটা চাই। আমরা দিনের শেষে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনারা কি সত্যি সত্যি পরিবর্তন চান নাকি আবারও আওয়ামী লীগের নৌকায় ফেরত যেতে চান? তাহলে ৫ আগস্ট সবাই মিলে যেভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন আবারও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। অধিকার আদায়ের জন্য, ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য, ভাতের অধিকারের জন্য এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য।’
জনগণের ভোটাধিকার আদায়ে রাজপথে নামার যে আহ্বান বিএনপি মহাসচিব জানিয়েছেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মহাসচিব প্রয়োজনে রাজপথে নামার কথা বলেছেন। তবে আমরা মনে করছি না সেটার প্রয়োজন হবে।’
এদিকে গতকাল দুপুরে দিনাজপুরের কাহারোলে অসহায় ও দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে নির্বাচন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে এবং এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করছে। সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম হবে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরই সরকার নির্বাচনের দিকে যাবে।’
সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি সংস্কার চায়। সংস্কার চায় বলেই সরকারকে সময় দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠন করেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকাজ শুরু করলে পরবর্তীকালে যে নির্বাচিত সরকার আসবে তারা সেই সংস্কার প্রস্তাব এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারে যারা উপদেষ্টা রয়েছেন তাদের বিভিন্ন অঙ্গণে অভিজ্ঞতা থাকলেও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তেমন একটা নেই। রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতা নেই। এখন পর্যন্ত কোনো সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তারা নিজেদের বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এভাবে চলতে থাকলে তারা নিজেরা যেমন বেকায়দায় পড়বে তেমনি দেশ ও দেশের মানুষকে বেকায়দায় ফেলবে। সবকিছুর সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক সরকারই করতে পারে। আর সে সরকার আসতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। অথচ নির্বাচনের কথা বললেই সরকারের দুয়েকজন উপদেষ্টা ও তাদের ঘনিষ্ঠরা নির্বাচন দাবিদারকে গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। এগুলো খুবই বিপজ্জনক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিএনপি সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। একটিমাত্র কারণে এ সমর্থন ও সহযোগিতা আর সেটি হলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণ। এই সরকারও জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে, মানুষের মাঝে আশা জাগিয়েছে। এর মধ্যে ভোটের অধিকার হলো প্রধান। এই দেশের মানুষ গত ১৪-১৫ বছর ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অতিদ্রুত জনগণের প্রত্যাশা যাতে এই সরকার পূরণ করে, সেজন্য আমরা নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার দাবি করে আসছি। এখনো কিন্তু পরিপূর্ণ রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। আমাদের দাবি পরিপূর্ণ রোডম্যাপ। এটা দিলে কোন দিনে নির্বাচন হবে তা জানা যাবে। জনগণ নির্বাচনমুখী হবে। তখন ছোটখাটো যে ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাই, তা জনগণের কাছে তখন পাত্তা পাবে না। তাই প্রয়োজনে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্য্যাপ ঘোষণার দাবি আদায়ে বিএনপি সোচ্চার থাকার পাশাপাশি অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করবে।’
বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলেও সেখান থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানামুখী কর্মকা- জনগণ দেখতে পাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনৈতিক সরকার দরকার। নির্বাচন বিলম্বিত হলে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। কোন সংস্কার কতদিনে হবে কিংবা কতটা হবে তারও তো নিশ্চয়তা নেই। এসব কারণেই জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে যেতে পারে।
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬-এর প্রথম দিকে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।’ পাশাপাশি ড. ইউনূস নির্বাচনের আগেই সব ধরনের সংস্কার সম্পন্ন করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
এর এক দিন পরই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মানুষ আশা করতে পারে। তার এমন মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপি। পরদিন বিএনপি মহাসচিব নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেছিলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। জনগণ এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে।
পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি নেতারা বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। কারণ তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বা রোডম্যাপ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেননি। আমরা বারবার নির্বাচন নিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি। তবে আমরা কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি এবং আশা করছি সরকার অন্তত নির্বাচন নিয়ে ভাবছে।
তারা বলেন, সরকার আন্তরিক হলে আগামী বছর মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, সরকারের এক বছর মেয়াদ প্রয়োজনীয় নির্বাচনী ও অন্যান্য সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি যৌক্তিক সময়সীমা দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারের ভেতরের কিছু লোক সংস্কারের নামে সময় কিনতে চায়, শুধু ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য।